আধুনিকতা ও আধিপত্য ভাষারীতিকে কিভাবে সংকটায়িত করে?
নভেম্বর ২৯, ২০২৫অনেক পশ্চিমা দেশে বিশেষত ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রে "এক দেশ, এক ভাষা" ধারনায় জাতীয় পরিচয় তৈরি হয়েছে। ভাষাগত বৈচিত্র্যকে প্রায়শই জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। বৈশ্বিক ইতিহাস ও আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় আধিপত্যের সুবাদে পশ্চিমা সংস্কৃতি নিজেকে প্রায়শই 'আদর্শ' বা 'আধুনিক' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে; ফলে অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে কখনও কখনও 'বহিরাগত', 'অপ্রচলিত' বা তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ন হিসেবে ভাবা হয়।
ভাষা মানুষের পরিচয়, সংস্কৃতি, ক্ষমতা ও জ্ঞানচর্চার একটি মৌলিক ভিত্তি। দীর্ঘ ইতিহাসে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে থাকে না; বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক বিশ্বে ইংরেজি ভাষার যে বিশাল আধিপত্য দেখা যায়, তা হঠাৎ করে গড়ে ওঠা কোনো ঘটনা নয়, বরং উপনিবেশিক ক্ষমতার বিস্তার, বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এবং বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর অ্যালগরিদমিক আধিপত্যের ধারাবাহিক প্রভাবের ফল। এই প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী ইংরেজিকে ক্ষমতাবান করেছে এবং বাংলা সহ অনেক অ-পশ্চিমা ভাষাকে ধীরে ধীরে প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব দেখায় কীভাবে একটি প্রভাবশালী ভাষা আদর্শগতভাবে নিজেকে “উচ্চতর”, “আধুনিক” বা “মর্যাদাপূর্ণ” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। একবার এই বিশ্বাস সমাজে গেঁথে গেলে মানুষ তা স্বাভাবিক সত্য হিসেবে ধরে নেয়। ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন শুধু ইংরেজিভাষী শিক্ষকই শ্রেষ্ঠ—এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত হয়। এসব ধারণা স্থানীয় ভাষার মর্যাদা কমিয়ে দেয় এবং ইংরেজিকে জ্ঞান ও উন্নতির একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলে। এভাবে ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের অজুহাতে অর্থনৈতিক সুযোগও ইংরেজিভাষী মানুষের দিকে বেশি ঝুঁকে যায়।
ভাষার স্থানান্তর দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। কোনো ভাষার সামাজিক মর্যাদা কমে গেলে মানুষ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অন্য ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই চাপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ দেখা গেছে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ভাষাগত অধিকার রক্ষার ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ। পরবর্তীতে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করতেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
উপনিবেশিক যুগে ভাষাকে শক্তি প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময় ম্যাকাওলের নীতিমালা স্থানীয় ভাষা ও জ্ঞানচর্চাকে দুর্বল করে ইংরেজিকে প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান ভাষা বানিয়ে দেয়। অন্যদিকে ফরাসি উপনিবেশে এমন ধারণা ছড়ানো হয় যে তাদের ভাষা সভ্যতার প্রতীক। এসব নীতি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সাধারণ জনগণকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং ইংরেজি-শিক্ষিত একটি বিশেষ শ্রেণি তৈরি করে।
বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো ইংরেজিকে আরও শক্তিশালী করে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মিডিয়া, চলচ্চিত্র—সব ক্ষেত্রেই ইংরেজি আধিপত্য তৈরি করে বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। এর ফলে মাতৃভাষা নয়, বরং ইংরেজিতে দক্ষতাকে পেশাগত যোগ্যতার প্রধান মানদণ্ড হিসেবে দেখা শুরু হয়। জন্মগত ইংরেজিভাষীদের শ্রমবাজারে যে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় সেটিও এই আধিপত্যের ফল।
ভাষাগত আধিপত্য শুধু রাষ্ট্র বা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; জনপরিসরের প্রতীক, যেমন রাস্তার সাইনবোর্ড, ভাষার দৃশ্যমানতাকে হুমকির মুখে ফেলে। কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু ভাষার সাইন সরানোর পেছনে “নিরাপত্তা” বা “কার্যকারিতা”র মতো অজুহাত দেখানো হয়, যা মূলত সাংস্কৃতিক দমনকে বৈধতা দেয়।
ভারতে অনেক স্থানে বাংলাভাষীরা ভাষাগত প্রান্তিকতা ও পরিচয় সংকটের মুখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাইরে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে প্রায়শই “বহিরাগত” হিসেবে দেখা হয়, ফলে শিক্ষা, কাজ বা জনপরিসরে মাতৃভাষা ব্যবহার নিরুৎসাহিত হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু এলাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ভুল ধারণার কারণে বাংলাভাষীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের ঘটনাও দেখা যায়। এসব পরিস্থিতি বাংলা ভাষার জনসমক্ষে দৃশ্যমানতা কমিয়ে দেয়, সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাষা-টিকে থাকার সংকট সৃষ্টি করে।
ডিজিটাল যুগে ভাষাগত বৈষম্য আরও জটিল রূপ নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল ও অনুবাদ সফটওয়্যারগুলির অধিকাংশই ইংরেজি বা ইউরোপীয় ভাষার বিপুল ডেটার উপর প্রশিক্ষিত। ফলে বাংলা সহ বহু ভাষা প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়ছে। অনুবাদ ভুল, তথ্য বিকৃতি এবং সাংস্কৃতিক ভুল উপস্থাপনা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলা অ-ল্যাটিন লিপিভিত্তিক হওয়ায় অনেক মেশিন লার্নিং টোকেনাইজার বাংলাকে ভেঙে অদক্ষভাবে প্রক্রিয়া করে, যা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আরও বাড়ায়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলা তথ্যের অভাব, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের অসম প্রতিফলন এবং মডেলের পক্ষপাতমূলক আচরণ।
যদিও এসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবু বিশ্বজুড়ে ভাষা পুনরুজ্জীবনের উদাহরণ আশার আলো দেখায়। হিব্রু, মাওরি বা কর্নিশ ভাষার পুনরুজ্জীবন প্রমাণ করেছে যে ভাষা সঠিক নীতি ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে পুনরায় শক্তিশালী হতে পারে। বাংলাদেশে প্রযুক্তিতে বাংলা ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন গবেষণা এবং সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শক্তিশালী বাংলা কর্পাস গঠন, স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা, এবং বহুভাষিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মাণ এসব উদ্যোগ ভবিষ্যতে ভাষাগত সমতা ও ন্যায্যতার পথ খুলতে পারে।
ভবিষ্যতে ভাষাগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে নৈতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রযুক্তি নির্মাণ অপরিহার্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে স্থানীয় সংস্কৃতি, উপভাষা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সক্ষম করে তুলতে হবে। ডেটা সংগ্রহ ও মডেল প্রশিক্ষণে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা ছাড়া ভাষাগত আধিপত্যের শেকড় ভাঙা সম্ভব নয়। শিক্ষা, প্রযুক্তি, রাষ্ট্রীয় নীতি এবং জনপরিসর সব ক্ষেত্রেই মাতৃভাষার সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ভাষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার ন্যায্য ভবিষ্যৎ তৈরি হবে।