অনুসন্ধান করুন

উচ্চ সম্পদশালী জনগোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে বাড়ছে


বিশ্বে ধনী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এই বৃদ্ধি কিছুটা আলাদা রকম। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতি বেড়েছে, আর এর সাথে মিলিওনিয়ারদের সংখ্যাও বাড়ছে। ২০২১ সালে দেশে প্রায় ২৯ হাজার মিলিওনিয়ারের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। যদিও এটি পুরোনো তথ্য, সাম্প্রতিক ব্যাংক রিপোর্ট দেখায় যে নতুন মিলিওনিয়ার অ্যাকাউন্ট দ্রুত বাড়ছে। যা দেশে সম্পদ সঞ্চয় বাড়ার দিকটি নির্দেশ করে। তবে এই বৃদ্ধির মান নিয়ে কিছু সন্দেহ আছে। কারণ ধারণা করা হয়, এই সম্পদের একটি অংশ দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। তাই সম্পদের বৃদ্ধি হলেও তা কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত এই ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। দেশটিতে লক্ষাধিক মিলিওনিয়ার রয়েছে, তবে জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যাটি এখনও খুব কম। ভারতের সমৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের মধ্যকার বৈষম্য এতটাই তীব্র যে একই সাথে মিলিওনিয়ারের সংখ্যা বাড়লেও বড় একটি জনগোষ্ঠী নিচু আয়মান জীবনযাপন করছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভারত থেকে অনেক সম্পদশালী মানুষ বিদেশে চলে যাচ্ছেন, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সিঙ্গাপুরে, যা জীবনযাত্রা, করনীতি বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে আকর্ষণীয়। এ কারণে সম্পদ বৃদ্ধির হার যেমন বাড়ছে, তেমনই সম্পদের দেশত্যাগও বাড়ছে।

বিশ্বব্যাপী মিলিওনিয়ার বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, বিশ্ব আর্থিক কাঠামোর কেন্দ্র হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে। ডলার বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত একধরনের সুবিধা পায় যা তাদের সম্পদ বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। এটি শুধু মুদ্রা ছাপানোর ক্ষমতার কারণে নয়, বরং ডলারকে ঘিরে বৈশ্বিক চাহিদা, নিরাপদ সম্পদ হিসেবে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের জনপ্রিয়তা এবং মূলধন বাজারের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে সম্পদ স্ফীতি দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বে বেশিরভাগ ধনী ব্যক্তি তাঁদের সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, বরং নিজেরা তৈরি করেন। অর্থনীতি, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, রিয়েল এস্টেট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত—এই সব ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি স্ব-নির্মিত সম্পদ সৃষ্টি হয়। বিশেষত প্রযুুক্তিভিত্তিক ব্যবসা দ্রুত বেড়ে ওঠায় তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তারা খুব অল্প বয়সেই বড় সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এশিয়ার মিলিওনিয়ারদের গড় বয়স উন্নত বিশ্বের তুলনায় কম হওয়াও এর স্পষ্ট প্রমাণ।

করনীতি মিলিওনিয়ারদের আচরণে বড় প্রভাব ফেলে। অধিকাংশ উন্নত দেশে আয়কর বেশি হলেও পুঁজিগত লাভের উপর কর তুলনামূলকভাবে কম। এর ফলে শেয়ার, সম্পত্তি বা স্টার্টআপে বিনিয়োগ করা ব্যক্তিরা দ্রুত তাদের সম্পদ বাড়াতে পারেন। আবার অনেকে কর-বান্ধব দেশগুলোতে চলে গিয়ে সম্পদ সংরক্ষণের আরও ভালো সুযোগ খোঁজেন। কর-দক্ষ কাঠামো, তারল্য সুবিধা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রায়ই তাদের স্থানান্তরের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।

মিলিওনিয়ারদের বিনিয়োগ চিত্রেও বড় পরিবর্তন এসেছে। নতুন প্রজন্ম বেশি ঝোঁক দেখাচ্ছে বিকল্প সম্পদের দিকে যেমন প্রাইভেট ইকুইটি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও ডিজিটাল সম্পদ। তারা প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মতো দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করছে এবং কর-দক্ষ পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সম্পদের দ্রুত সৃষ্টি হলেও এই সম্পদ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। জীবনযাত্রার মান, আইনের কঠোরতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী আর্থিক কাঠামো নিশ্চিত না করতে পারলে ধনীরা দেশত্যাগ করতে পারে। তাই সম্পদ সৃষ্টি যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই সুশাসন, আধুনিক পুঁজিবাজার, কর-দক্ষ কাঠামো এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

দক্ষিণ এশিয়ায় সম্পদ বৃদ্ধির গতি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক, কিন্তু এই বৃদ্ধিকে স্থায়ী করতে হলে দেশগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে সম্পদ সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও বিনিয়োগ একই সাথে সম্ভব হয়। তবেই এই অঞ্চলের অর্থনীতি বিশ্বে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

বিভাগ:
লেখকগণ: