অনুসন্ধান করুন

টাইম মেশিন প্রযুক্তি তৈরি করা কি অসম্ভব?


সময়ের ধারণা মানবসভ্যতার শুরু থেকেই কৌতূহলের বিষয়। মানুষ সময়কে সবসময়ই একমুখী প্রবাহ হিসেবে দেখেছে। অতীত থেকে বর্তমান, তারপর ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আবির্ভাবের পর সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা বদলে গেছে। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দেখিয়েছে যে সময় স্থির কোনো জিনিস নয়; বরং এটি বেগ, মাধ্যাকর্ষণ এবং পর্যবেক্ষকের অবস্থার উপর নির্ভর করে ভিন্নভাবে প্রবাহিত হতে পারে। এই ধারণাই সময়যন্ত্র বা টাইম মেশিনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও গভীর গবেষণা করছেন। তবে সম্ভাবনা যতটা আকর্ষণীয়, সীমাবদ্ধতাগুলোও ততটাই জটিল।

আপেক্ষিকতার নিয়ম অনুযায়ী ভবিষ্যতের দিকে সময়যাত্রা আসলে বাস্তব। যখন কোনো বস্তু খুব বেশি গতিতে চলে বা খুব শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণে অবস্থান করে, তখন তার জন্য সময় ধীরগতিতে চলে। এ ঘটনাকে বলা হয় কাল দীর্ঘায়ন বা টাইম ডিলেশন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা নভোচারীরা পৃথিবীর মানুষের তুলনায় অল্প কিছু কম বয়সী হয়ে ফিরে আসেন, কারণ তারা উচ্চগতিতে ঘুরছেন এবং পৃথিবীর তুলনায় দুর্বল মাধ্যাকর্ষণে আছেন। GPS স্যাটেলাইটগুলোর ঘড়িতেও এই প্রভাবের সংশোধন না করলে প্রতিদিন বিশাল পরিমাণ ত্রুটি সৃষ্টি হতো। এর মানে হলো—ভবিষ্যতের দিকে ছোটখাটো সময়যাত্রা প্রতিদিনই ঘটছে, শুধু তা মানুষের জন্য তেমনভাবে অনুভবযোগ্য নয়।

কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন আমরা অতীতে ভ্রমণের কথা ভাবি। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে কিছু সমাধান পাওয়া যায়, যা বলে যে স্থান-কালের জ্যামিতিকে বিশেষভাবে পরিবর্তন করলে একটি সময়-লুপ তৈরি হতে পারে। যাকে বলা হয় বদ্ধ কালসদৃশ রেখা—যেখানে কোনো বস্তু একই সঙ্গে সামনের দিকে এগোতে এগোতে অতীতের কোনো বিন্দুতে ফিরে যেতে পারে। তত্ত্ব হিসেবে এটি গণিতে ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবে তৈরি করতে হলে প্রয়োজন হবে এমন এক ধরনের পদার্থ যার শক্তি ঘনত্ব ঋণাত্মক। এই ধরনের বহিরাগত পদার্থ বা এক্সোটিক ম্যাটার ক্ষুদ্রতম স্কেলে ক্যাসিমিয়র প্রভাবের মতো কিছু পরিস্থিতিতে দেখা গেলেও, বৃহৎ স্কেলে তা তৈরি বা ব্যবহার করা বর্তমানে অসম্ভব। সময়যন্ত্র তৈরির জন্য যে পরিমাণ ঋণাত্মক শক্তি দরকার, তা হয়তো পুরো মহাবিশ্বের অর্ধেক শক্তির সমান হতে পারে, যা বাস্তবতার সঙ্গে কোনোভাবেই মিলিয়ে দেখা যায় না।

অতীতভ্রমণের ক্ষেত্রে আরও বড় সমস্যা দেখা দেয় কার্যকারণ বা কারণ-ফল সম্পর্কের নিয়মে। কেউ যদি অতীতে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব পরিবর্তন করে দেয়, তাহলে তা লজিক্যালভাবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের প্যারাডক্স এড়াতে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধারণা দিয়েছেন। যেমন—নোভিকভের স্ব-সংগতি নীতি বলে, অতীতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটানো অসম্ভব যা বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গত। অর্থাৎ, আপনি অতীতে গেলে আপনার কাজগুলো আগেই ইতিহাসে নির্ধারিত ছিল। অন্যদিকে বহু-বিশ্ব ব্যাখ্যা বলে, আপনি অতীতে গিয়ে কিছু পরিবর্তন করলে নতুন টাইমলাইন তৈরি হবে, মূল সময়রেখা অক্ষত থাকবে। যদিও এই ব্যাখ্যাগুলো আকর্ষণীয়, এগুলোর কোনোটি এখনও পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত নয়।

স্টিফেন হকিংয়ের কালানুক্রমিক সুরক্ষা অনুমান আরও কঠোর অবস্থান নেয়। তিনি বলেন, প্রকৃতির আইন নিজেই এমনভাবে কাজ করে যে অতীতে সময়যাত্রা সম্ভব হওয়ার আগেই কোয়ান্টাম প্রভাব সেই কাঠামো ধ্বংস করে দেয়। কারণ CTC(Closed Timelike Curve - সময়-স্থানের একটি পথ যা অতীতে ফিরে আসতে পারে) তৈরি হলে তার আশেপাশে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন এত বাড়তে থাকে যে সেটি সময়যন্ত্রকে অকার্যকর করে ফেলে। অর্থাৎ, সময়যন্ত্র শুধু প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন নয়—মহাবিশ্ব নিজেই তা হতে দেবে না বলে মনে হয়।

এই সব বিশ্লেষণ মিলিয়ে দেখা যায়, ভবিষ্যতের দিকে সময়যাত্রা বাস্তবিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্ভব হলেও তা মানবজীবনের পরিমাপে অর্থবহ করার মতো প্রযুক্তি এখনও আমাদের নেই। এর জন্য প্রয়োজন প্রায় আলোর গতির সমান গতি অর্জন করা, যা অর্জনে অসীম শক্তি প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে অতীতের দিকে সময়যাত্রা তত্ত্বে সম্ভব হলেও বাস্তবে তা মহাবিশ্বের মৌলিক নিয়মের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে, যা এটিকে কার্যত অসম্ভব করে তোলে। তবু সময়যন্ত্রের ধারণা আমাদের চিন্তাশক্তিকে আরও বিস্তৃত করে এবং বিজ্ঞানকে মহাবিশ্বের মৌলিক নিয়ম নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধানে উৎসাহিত করে।

বিভাগ:
লেখকগণ: