অনুসন্ধান করুন

লুনা ১১ এর অব্যার্থতা


সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ১১ মিশন ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মহাকাশ প্রতিযোগিতার একটি সূচকীয় অধ্যায়, যেখানে উন্নত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও নতুন প্রজন্মের অরবিটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাঁদের কক্ষপথে বিশদ বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করা হয়েছিল। এটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Lunar Orbiter 1 উৎক্ষেপণের মাত্র দুই সপ্তাহ পরে। লুনা প্রোগ্রামের দ্বিতীয় প্রজন্মভুক্ত এই মহাকাশযানের মূল লক্ষ্য ছিল চাঁদের কক্ষপথ থেকে তার পৃষ্ঠের গঠন, বিকিরণ পরিবেশ, এবং মহাজাগতিক কণার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা, যা ভবিষ্যৎ মানববাহী অভিযানের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। ১৯৬৬ সালের ২৪ আগস্ট উৎক্ষেপণ ও ২৭ আগস্ট সফলভাবে চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশের পর এটি মোট ২৭৭ বার চাঁদ প্রদক্ষিণ করে এবং পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে ১৩৭টি সফল ট্রান্সমিশন পাঠায়। যদিও মিশনের অনেক বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য পূর্ণ হয়েছিল, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের পৃষ্ঠের উচ্চ রেজোলিউশনের ছবি তোলা যা অ্যাটিটিউড কন্ট্রোল সিস্টেমের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ব্যর্থ হয়।

লুনা ১১ ছিল E-6LF মডেল ব্যবহার করে নির্মিত, যা পূর্বসূরি লুনা ১০ থেকে বেশ উন্নত। এটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল যাতে 'পেলোড' মূল বাসের সাথে সংযুক্ত থেকে শক্তি, যোগাযোগ ও দিকনির্দেশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারে। সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য ছিল এই মিশনের মাধ্যমে উচ্চমানের চিত্র সংগ্রহ করা এবং ভবিষ্যৎ মানববাহী অভিযানের জন্য সম্ভাব্য অবতরণ স্থান নির্ধারণ করা। কিন্তু একটি ক্ষুদ্র বিদেশী বস্তু থ্রাস্টারের সামনে আটকে যাওয়ায় পুরো ফটোগ্রাফি ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, কৌশলগত দিক থেকেও সোভিয়েতদের জন্য বড় ধাক্কা ছিল, কারণ এর মাধ্যমে তারা মার্কিন Lunar Orbiter প্রোগ্রামের সাফল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি।

তবুও লুনা ১১-এর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক ফলাফল ছিল উল্লেখযোগ্য। এটি চাঁদের অভিকর্ষজ ক্ষেত্র, বিকিরণ পরিবেশ ও ক্ষুদ্র উল্কাপাত প্রবাহ নিয়ে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে। এর ডেটা থেকে বিজ্ঞানীরা ‘মাসকন’ বা চাঁদের অভ্যন্তরের অতিরিক্ত মাধ্যাকর্ষণযুক্ত অঞ্চলের প্রমাণ পান যা ভবিষ্যৎ মিশনের নিরাপদ নেভিগেশনের জন্য অপরিহার্য ছিল। বিকিরণ ডিটেক্টর সৌর প্রোটন ফ্লাক্স ও মহাজাগতিক বিকিরণের সম্পর্ক নির্ধারণ করে, যা নভোচারীদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা পরিকল্পনায় সহায়তা করেছিল। পাশাপাশি, ক্ষুদ্র উল্কা ডিটেক্টর মহাকাশযানের সুরক্ষা ও কাঠামোগত পরিকল্পনায় ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।

লুনা ১১-এর সবচেয়ে সফল প্রকৌশল পরীক্ষাগুলির মধ্যে ছিল R-1 ট্রান্সমিশন এক্সপেরিমেন্ট, যা শূন্যস্থানে গিয়ার লুব্রিকেন্টের কার্যকারিতা যাচাই করে। এই পরীক্ষার ফল Lunokhod রোভার প্রোগ্রামের ভিত্তি গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। এভাবেই লুনা ১১ যদিও তার প্রধান কৌশলগত উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হয়, তবুও এটি সোভিয়েত মহাকাশ প্রকৌশলের ধারাবাহিকতা ও দূরদর্শিতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত, ব্যাটারি শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেলে ১৯৬৬ সালের ১ অক্টোবর লুনা ১১-এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। তবুও এর সংগৃহীত ডেটা চাঁদের বৈজ্ঞানিক মডেলিংয়ে এবং সোভিয়েত L3 মানববাহী প্রোগ্রামের পরিকল্পনায় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে লুনা ১২ ও লুনা ১৪ মিশনের নকশা ও লক্ষ্য নির্ধারণেও এর অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রভাবিত করে। লুনা ১১ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ মনে হলেও এটি ছিল আংশিকভাবে সফল, যেখানে প্রতিটি যান্ত্রিক ত্রুটি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য পথ তৈরি করে যায়।

বিভাগ:
লেখকগণ: